সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

বাইবেল জীবনকে পরিবর্তন করে

আমি মহিলাদের আর সেইসঙ্গে নিজেকে সম্মান করতে শিখেছি

আমি মহিলাদের আর সেইসঙ্গে নিজেকে সম্মান করতে শিখেছি
  • জন্ম: ১৯৬০ সাল

  • দেশ: ফ্রান্স

  • ইতিহাস: আগে আমি অত্যধিক মাত্রায় ড্রাগস নিতাম এবং মহিলাদের অসম্মান করতাম

আমার অতীত:

আমি উত্তর-পূর্ব ফ্রান্সের মুলুসের একটা শহরতলিতে জন্মগ্রহণ করি। সেখানে প্রধানত শ্রমিকেরা বাস করত এবং সেই জায়গাটা অপরাধমূলক কাজের জন্য কুখ্যাত ছিল। ছেলেবেলার স্মৃতি বলতে সেই এলাকার পরিবারগুলোর মধ্যে হিংস্র মারামারির কথাই আমার মনে পড়ে। আমাদের পরিবারে পুরুষেরা মহিলাদের নীচু চোখে দেখত আর তাদের ইচ্ছাকে কোনো গুরুত্ব দিত না বললেই চলে। ছোটোবেলা থেকে আমি এটাই শিখেছি, মহিলাদের স্থান হল রান্নাঘর আর তাদের দায়িত্ব হল, স্বামী ও সন্তানের যত্ন নেওয়া।

আমার ছেলেবেলা কষ্টকর পরিস্থিতির মধ্যে কেটেছে। দশ বছর বয়সে আমি আমার বাবাকে হারাই। মদ খাওয়ার কারণে তিনি মারা যান। এই ঘটনার পাঁচ বছর পর, আমার এক দাদা আত্মহত্যা করেন। সেই একই বছরে, পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে আমার চোখের সামনে একজন আত্মীয়কে হত্যা করা হয় আর সেটা দেখে আমি খুবই ভয় পেয়ে যাই। পরিবারের সদস্যদের হাত ধরেই আমি মারামারি করতে এবং ছুরি ও বন্দুক চালাতে শিখি। জীবনে কোনো উদ্দেশ্য না থাকায় আমি নিজের শরীরে একের-পর-এক ট্যাটু করতে ও মদ খেতে শুরু করি।

আমার বয়স যখন ১৬ বছর, তখন আমি দিনে ১০ থেকে ১৫ বোতল বিয়ার খেতাম। এর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আমি ড্রাগস নিতে শুরু করি। নেশার খরচ মেটানোর জন্য আমি পুরোনো জিনিসপত্র বিক্রি করতে আর সেইসঙ্গে চুরি করতে শুরু করি। আমার বয়স যখন ১৭ বছর, তখন ইতিমধ্যেই আমার জেল খাটা হয়ে গিয়েছে। চুরি ও মারামারি করার দায়ে সব মিলিয়ে আমি ১৮টা দোষে দোষী সাব্যস্ত হই।

২০-র কোঠার প্রথম দিকে আমার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়। কখনো কখনো আমি দিনে ২০টা গাঁজার সিগারেট খেতাম। এ ছাড়া, হেরোইন ও অন্যান্য ড্রাগস নিতাম। একাধিক বার, অত্যধিক মাত্রায় ড্রাগস নেওয়ার ফলে আমি মরতে মরতে বেঁচেছি। যেহেতু আমি ড্রাগস লেন-দেন করতে শুরু করি, তাই আমার কাছে সবসময় ছুরি ও বন্দুক থাকত। একবার আমি একজন ব্যক্তিকে মারার জন্য গুলি চালাই কিন্তু ভালো যে, গুলিটা তার বেল্টের বগলসে লেগে বেরিয়ে যায়! ২৪ বছর বয়সে আমি আমার মাকে হারাই। মাকে হারিয়ে আমি আরও উগ্র হয়ে যাই। পথচারীরা আমাকে দেখলে ভয়ে রাস্তার উলটো দিকে পালিয়ে যেত। মারামারি করার কারণে সপ্তাহের শেষের দিনগুলো প্রায়ই আমাকে হয় পুলিশ স্টেশনে, নাহয় ক্ষত সেলাই করার জন্য হাসপাতালে কাটাতে হতো।

২৮ বছর বয়সে আমি বিয়ে করি। আপনারা হয়তো বুঝতেই পারছেন, আমার স্ত্রীকে আমি কতটা ‘সম্মান’ করতাম! অপমান ও মারধর একটা সাধারণ বিষয় ছিল। দম্পতি হিসেবে আমরা একসঙ্গে কোনো কাজ করিনি। আমি মনে করতাম, চুরি করা গয়নাগাটি দিয়ে ভরিয়ে দিলেই সে সন্তুষ্ট থাকবে। এরপর, একদিন এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। আমার স্ত্রী যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করে। প্রথম দিন অধ্যয়ন করার পর সে ধূমপান করা বন্ধ করে দেয়। সে চুরি করা টাকা নিতে অস্বীকার করে আর আমাকে তার গয়নাগাটি ফিরিয়ে দেয়। এতে আমি রাগে ফেটে পড়ি। আমি তাকে বাইবেল অধ্যয়ন বন্ধ করার জন্য জোর করি আর তার মুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে থাকি। শুধু তা-ই নয়, পাড়াপ্রতিবেশীর সামনে আমি তাকে অপমান করি।

একদিন রাতে মদের নেশায় চুর হয়ে আমি আমার নিজের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিই। আমার স্ত্রী আমাকে ও আমাদের পাঁচ বছরের মেয়েকে আগুনের হাত থেকে বাঁচায়। নেশার ঘোর কেটে যাওয়ার পর আমি বুঝতে পারি, আমি কত বড়ো ভুল করেছি! আমার মনে হতে থাকে, ঈশ্বর আমাকে কখনো ক্ষমা করবেন না। এক পাদরির কথা আমার মনে পড়ে, যিনি বলেছিলেন, পাপীরা নরকে যায়। এমনকী আমার ডাক্তারও আমাকে বলেছিলেন, “তোমার সুস্থ হওয়ার কোনো আশাই নেই! সব কিছু শেষ হয়ে গিয়েছে।”

বাইবেল যেভাবে আমার জীবনকে পরিবর্তন করেছে:

সেই রাতের ঘটনার পর আমি পরিবার নিয়ে আমার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উঠি। সেখানে যখন যিহোবার সাক্ষিরা আমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তখন আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করি, “ঈশ্বর কি আমার মতো পাপীকে ক্ষমা করতে পারেন?” তারা আমাকে বাইবেল থেকে ১ করিন্থীয় ৬:৯-১১ পদ দেখান। সেখানে সেইসমস্ত আচরণের বিষয়ে লেখা আছে, যেগুলো ঈশ্বর ঘৃণা করেন, কিন্তু সেখানে এটাও লেখা আছে: “তোমরা কেহ কেহ সেই প্রকার লোক ছিলে।” সেই কথাগুলো আমাকে এই বিষয়ে নিশ্চিত করেছিল, আমি পরিবর্তিত হতে পারব। এরপর সাক্ষিরা আমাকে ১ যোহন ৪:৮ পদ থেকে এই আশ্বাস দেন, ঈশ্বর আমাকে ভালোবাসেন। উৎসাহিত হয়ে আমি তাদেরকে বলি, যেন তারা আমার সঙ্গে সপ্তাহে দু-বার বাইবেল অধ্যয়ন করেন। আমি খ্রিস্টীয় সভাগুলোতে যোগ দিতে শুরু করি আর বার বার প্রার্থনায় যিহোবার সঙ্গে কথা বলতে থাকি।

এক মাসের মধ্যে আমি ড্রাগস নেওয়া ও মদ খাওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিই। শীঘ্রই এর প্রভাব আমার শরীরে এসে পড়ে। নেশা করার জন্য আমি ছটফট করতাম, রাতে ভয়ানক দুঃস্বপ্ন আসত, মাথাব্যথা করত আর যন্ত্রণায় শরীর কুঁকড়ে যেত। কিন্তু একই সময়ে আমি অনুভব করতাম, যিহোবা আমার হাত শক্ত করে ধরে আছেন আর আমাকে সহ্য করার শক্তি দিচ্ছেন। আমি প্রেরিত পৌলের মতো অনুভব করেছিলাম। ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া সাহায্যের বিষয়ে পৌল লিখেছিলেন: “যিনি আমাকে শক্তি দেন, তাঁহাতে আমি সকলই করিতে পারি।” (ফিলিপীয় ৪:১৩) শুরুতে অসম্ভব বলে মনে হলেও, একসময় আমি ধূমপান করা ছেড়ে দিই।—২ করিন্থীয় ৭:১.

বাইবেল যে শুধুমাত্র আমার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করেছে, তা-ই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে আমার পারিবারিক জীবনে সুখ নিয়ে এসেছে। স্ত্রীকে এখন আর আমি নীচু চোখে নয় বরং সম্মানের চোখে দেখি। কথা বলার সময়ও আমি মার্জিত ভাষা ব্যবহার করি। শুধু তা-ই নয়, একজন ভালো বাবা হওয়ার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি। এক বছর বাইবেল অধ্যয়ন করার পর আমার স্ত্রীর উত্তম উদাহরণ অনুসরণ করে আমিও যিহোবার কাছে নিজের জীবন উৎসর্গ করি ও বাপ্তিস্ম নিই।

আমি যেভাবে উপকৃত হয়েছি:

আমি আস্থার সঙ্গে বলতে পারি, বাইবেলের নীতি আমার জীবনকে পরিবর্তন করেছে। এমনকী আমার পরিবারের যে-সদস্যরা যিহোবার সাক্ষি নয়, তারাও এই বিষয়টা স্বীকার করে, সাক্ষি না হলে হয় আমি অত্যধিক নেশা করে নতুবা কারো সঙ্গে মারামারি করে প্রাণ হারাতাম।

একজন স্বামী ও বাবা হিসেবে আমার দায়িত্ব কী, তা বাইবেল আমাকে শিখিয়েছে আর এর ফলে আমার পারিবারিক জীবন পুরোপুরি পালটে গিয়েছে। (ইফিষীয় ৫:২৫; ৬:৪) আমরা পরিবারগতভাবে একসঙ্গে কাজ করতে শুরু করি। এখন আমি আমার স্ত্রীকে আর রান্না ঘরে বন্দি করে রাখি না। এর পরিবর্তে, আমি আনন্দের সঙ্গে তাকে প্রচার কাজে সাহায্য করি; সে প্রতি মাসে প্রায় ৭০ ঘণ্টা প্রচার কাজে ব্যয় করে। বর্তমানে আমি মণ্ডলীতে একজন প্রাচীন হিসেবে সেবা করছি আর আমার স্ত্রী আমাকে সেই কাজে সমর্থন করতে পেরে খুব খুশি।

যিহোবা ঈশ্বরের প্রেম ও করুণা আমার জীবনের উপর গভীর ছাপ ফেলেছে। যাদের জীবনে কোনো আশা নেই, তাদেরকে যিহোবার চমৎকার গুণাবলি সম্বন্ধে জানানোর জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি, কারণ আমি তাদের যন্ত্রণা ভালোভাবে বুঝি। আমি জানি, যেকোনো ব্যক্তির জীবনকে শুদ্ধ ও উদ্দেশ্যপূর্ণ করে তোলার ক্ষমতা বাইবেলের রয়েছে। বাইবেল যে কেবলমাত্র অন্যদের প্রতি প্রেম ও সম্মান গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে, তা-ই নয় বরং এটি আমাকে নিজের প্রতি সম্মান গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। ▪ (w16-E No. 3)