সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন | সারা

ঈশ্বর তাকে “রাণী” বলে সম্বোধন করেছিলেন

ঈশ্বর তাকে “রাণী” বলে সম্বোধন করেছিলেন

সারা তার হাতের কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়ান এবং দিগন্তের দিকে তাকান। চারপাশে দাস-দাসীরা তার বিজ্ঞ নির্দেশনার অধীনে আনন্দের সঙ্গে কাজে ব্যস্ত। পরিশ্রমী সারাও নিজের কাজ করছিলেন। কল্পনা করুন, তিনি হয়তো নিজের হাতের ব্যথা দূর করার জন্য দু-হাত ঘসছেন আর কিছু চিন্তা করছেন। তারা যে-তাঁবুতে থাকতেন, সেটার কোনো ছেঁড়া অংশ হয়তো তিনি এতক্ষণ ধরে সেলাই করছিলেন। খসখসে ছাগলোম দিয়ে তৈরি কাপড়ের উজ্জ্বলতা বহু বছর সূর্যের তাপে ও বৃষ্টিতে ম্লান হয়ে গিয়েছে আর তা দেখে সারার মনে পড়ে, কত বছর ধরে তারা যাযাবরের মতো জীবনযাপন করছে। বিকেল গড়িয়ে গোধূলির আলো দেখা দিয়েছে। তিনি সেই সকাল বেলা অব্রাহামকে * তাঁবু থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছেন আর তিনি এখন সেই দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছেন। কাছাকাছি একটা পাহাড়ের চূড়ায় তার স্বামীর মতো কাউকে দেখতে পেয়ে তার সুন্দর মুখে হাসি ফুটে ওঠে।

অব্রাহাম তার বিশাল পরিবার নিয়ে ফরাৎ নদী অতিক্রম করে কনানে আসার পর দশ বছর কেটে গিয়েছে। অজানা জায়গার উদ্দেশে বহু দূরের এই যাত্রায় সারা স্বেচ্ছায় তার স্বামীকে সহযোগিতা করেছিলেন কারণ তিনি জানতেন যিহোবার উদ্দেশ্য অনুযায়ী এক অনুগ্রহপ্রাপ্ত বংশ ও জাতি উৎপন্ন করার ক্ষেত্রে তার স্বামীকে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু, সারা কোন ভূমিকা পালন করবেন? তিনি তো শুরু থেকেই বন্ধ্যা আর এখন তার ৭৫ বছর বয়স। তিনি হয়তো এই ভেবে দুশ্চিন্তা করতে থাকেন, ‘আমি যতদিন অব্রাহামের স্ত্রী থাকব, ততদিন কীভাবে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হতে পারে?’ তিনি যদি এই নিয়ে উদ্‌বিগ্ন হয়েও থাকেন এমনকী অধৈর্য হয়ে পড়েন, তা হলে তার পরিস্থিতি বোঝা কঠিন নয়।

আমরাও একেক সময় হয়তো এই ভেবে দুশ্চিন্তা করি, কখন ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হবে। আমরা যখন ভালো কিছু পাওয়ার জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা করে থাকি, তখন আমাদের পক্ষে ধৈর্য ধরা সহজ হয় না। আমরা এই অসাধারণ নারীর বিশ্বাস থেকে কী শিখতে পারি?

“সদাপ্রভু আমাকে বন্ধ্যা করিয়াছেন”

এই পরিবার সবেমাত্র মিশর থেকে ফিরে এসেছে। (আদিপুস্তক ১৩:১-৪) তারা বৈথেলের দক্ষিণ দিকে তাঁবু ফেলেছে, যে-নগরটাকে কনানীয়রা লূস বলত। এই উচ্চ মালভূমি থেকে সারা প্রতিজ্ঞাত দেশের অনেকটা অংশ দেখতে পেতেন। সেখানে বেশ কিছু কনানীয় গ্রাম ছিল। সেখানকার রাস্তা দিয়ে লোকেরা দূরদূরান্তে যেতে পারত। কিন্তু সেখানে যা-কিছু তার চোখে পড়ত, সেগুলোর মধ্যে কোনোটাই তার নিজের নগরের মতো ছিল না। তিনি মেসোপটেমিয়া নগর ঊরে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন, যেটা এখান থেকে ১,৯০০ কিলোমিটার (১,২০০ মাইল) দূরে অবস্থিত ছিল। সেখানে তিনি অনেক কিছু পিছনে ফেলে এসেছেন, যেমন তার আত্মীয়স্বজন, বড়ো বড়ো হাট-বাজার রয়েছে এমন এক সমৃদ্ধশালী নগরে থাকার সুবিধা এবং তার আরামদায়ক ঘর। সেখানকার ঘরগুলোতে পাকা ছাদ ও দেওয়াল ছিল, হয়তো-বা জল সরবরাহের ব্যবস্থাও ছিল! কিন্তু আমরা যদি মনে করি, সারা তার ছোটোবেলার ঘরের আরামআয়েশের কথা ভেবে দুঃখের সঙ্গে পূর্ব দিকে তাকিয়ে রয়েছেন, তা হলে আমরা এই ঈশ্বরভয়শীল নারী সম্বন্ধে কিছুই জানি না।

প্রায় ২০০০ বছর পর প্রেরিত পৌল অনুপ্রাণিত হয়ে যে-কথাগুলো লিখেছিলেন, তা লক্ষ করুন। অব্রাহাম ও সারার বিশ্বাস সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি লেখেন, তারা “যে দেশ হইতে বাহির হইয়া ছিলেন, সেই দেশ যদি মনে রাখিতেন, তবে ফিরিয়া যাইবার সুযোগ অবশ্য পাইতেন।” (ইব্রীয় ১১:৮, ১১, ১৫) সারা ও অব্রাহাম কেউই তাদের পিছনে ফেলে আসা বিষয়গুলোর প্রতি আকাঙ্ক্ষা করেননি। তারা যদি সেই ধরনের চিন্তাভাবনায় ডুবে থাকতেন, তা হলে তারা হয়তো বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু তারা যদি ঊরে ফিরে যেতেন, তা হলে তারা যিহোবার দেওয়া এই অসাধারণ সুযোগ হারিয়ে ফেলতেন। আর সেইসঙ্গে লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়স্পর্শকারী বিশ্বাসের উদাহরণ স্থাপনকারী হওয়ার পরিবর্তে তারা তাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেত।

পিছনে ফিরে তাকানোর পরিবর্তে সারা সামনের দিকে তাকিয়েছিলেন। আর তাই তিনি তার স্বামীকে সেই দেশে সাময়িকভাবে বসবাস করার ক্ষেত্রে ক্রমাগত সমর্থন জুগিয়েছিলেন। তাঁবু গুটিয়ে পশুপাল নিয়ে আবার অন্য জায়গায় গিয়ে তাঁবু খাটানোর কাজে তিনি অব্রাহামকে সাহায্য করতেন। এ ছাড়া, অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও পরিবর্তনও তিনি সহ্য করেছিলেন। যিহোবা পুনরায় অব্রাহামের কাছে তাঁর প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছিলেন কিন্তু সারার সম্বন্ধে কিছুই বলা হয়নি!—আদিপুস্তক ১৩:১৪-১৭; ১৫:৫-৭.

পরিশেষে, সারা অব্রাহামের কাছে এমন এক পরিকল্পনা সম্বন্ধে জানান, যেটা বেশ কিছুদিন ধরে তার মাথায় ঘুরছিল। তিনি অব্রাহামকে বলেন: “দেখ, সদাপ্রভু আমাকে বন্ধ্যা করিয়াছেন।” এই কথাগুলো বলার সময় সারার চোখে-মুখে ফুটে ওঠা দু-ধরনের অনুভূতির কথা কল্পনা করুন। এরপর তিনি তার স্বামীকে অনুরোধ করেন, যেন তিনি তার দাসী হাগারের মাধ্যমে সন্তানের পিতা হন। আপনি কি চিন্তা করতে পারেন, এই কথাগুলো বলা সারার পক্ষে কতটা কষ্টকর ছিল? আমাদের দিনে এই ধরনের অনুরোধ হয়তো অদ্ভুত শোনাতে পারে কিন্তু সেই সময় উত্তরাধিকার উৎপন্ন করার জন্য একজন পুরুষের পক্ষে আরেকজন স্ত্রী অথবা উপপত্নী গ্রহণ করা খুবই সাধারণ বিষয় ছিল। * সারা হয়তো মনে করেছিলেন, এ-ভাবে অব্রাহামের মাধ্যমে এক জাতি উৎপন্ন করার বিষয়ে যিহোবার উদ্দেশ্য বাস্তবে পরিণত হবে। যেভাবেই হোক না কেন, তিনি আত্মত্যাগ করতে ইচ্ছুক ছিলেন আর সেটা তার পক্ষে খুবই কষ্টকর ছিল। অব্রাহাম কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন? বিবরণে আমরা পড়ি, তিনি “[সারার] বাক্যে সম্মত হইলেন।”—আদিপুস্তক ১৬:১-৩.

বিবরণ কি ইঙ্গিত দেয়, যিহোবাই সারাকে এই প্রস্তাব দিতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন? অবশ্যই না। এর পরিবর্তে, সারার প্রস্তাব প্রকাশ করে, তিনি বিষয়টা একেবারে মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন ঈশ্বরই তাকে বন্ধ্যা করেছেন আর ঈশ্বরের কাছে সমাধানের যে অন্য এক উপায় রয়েছে, এই কথাটা তার মাথায় আসেনি। সারা নিজস্ব উপায়ে সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সেটাই তার জীবনে কষ্ট ও সমস্যা ডেকে এনেছিল। তা সত্ত্বেও, তার এই প্রস্তাব দেখায়, তিনি নিঃস্বার্থপর ছিলেন আর তা সত্যিই প্রশংসনীয়। পৃথিবীতে মানুষেরা যখন ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাকে অন্য কিছু থেকে বেশি প্রাধান্য দেয়, সেখানে সারার এই নিঃস্বার্থপর মনোভাব কি আমাদের মুগ্ধ করে না? আমরা যদি স্বার্থপর আকাঙ্ক্ষা পরিপূর্ণ করার চেয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যকে আমাদের জীবনে অগ্রাধিকার দিই, তা হলে আমরা সারার বিশ্বাসকে অনুকরণ করব।

“অবশ্য হাসিয়াছিলে”

কিছু দিনের মধ্যেই হাগার অব্রাহামের দ্বারা গর্ভবতী হন। গর্ভবতী হওয়ায় হাগার হয়তো নিজেকে সারার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন আর তাই তিনি তার কর্ত্রীকে অবজ্ঞা করতে শুরু করেন। বন্ধ্যা সারার জন্য তা কত দুঃখজনকই-না ছিল! অব্রাহামের অনুমতি নিয়ে এবং ঈশ্বরের সমর্থনে সারা তাকে শাস্তি দেন। তবে তাকে কোন ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, সেই সম্বন্ধে বাইবেল আমাদের কিছু জানায় না। এরপর হাগার ইশ্মায়েলকে জন্ম দেন আর বেশ কয়েক বছর কেটে যায়। (আদিপুস্তক ১৬:৪-৯, ১৬) বাইবেলের বিবরণ দেখায়, সারার বয়স যখন ৮৯ বছর আর তার স্বামীর ৯৯ বছর, তখন তারা যিহোবার কাছ থেকে এক বার্তা পান। আর সেই বার্তা কতই-না চমৎকার ছিল!

যিহোবা পুনরায় তাঁর বন্ধু অব্রাহামের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন, তিনি তার বংশকে বৃদ্ধি করবেন। এ ছাড়া, ঈশ্বর এই ব্যক্তির নাম পরিবর্তন করেন। এত দিন পর্যন্ত তিনি অব্রাম নামে পরিচিত ছিলেন কিন্তু যিহোবা তার নতুন নামকরণ করেন অব্রাহাম আর এই নামের অর্থ হল “বহুলোকের পিতা।” আর এই প্রথম বার, যিহোবা তাঁর উদ্দেশ্যের মধ্যে সারার ভূমিকা সম্বন্ধে উল্লেখ করেন। এত দিন পর্যন্ত তার নাম ছিল সারী, যেটার অর্থ হয়তো ‘প্রতিযোগী’ কিন্তু এখন যিহোবা তা পরিবর্তন করে সারা রাখেন আর এই নামেই তিনি আমাদের সবার কাছে সুপরিচিত। সারা নামের অর্থ কী? “রাণী”! কেন যিহোবা তার জন্য এই নাম বাছাই করেছেন, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন: “আমি তাহাকে আশীর্ব্বাদ করিব, এবং তাহা হইতে এক পুত্ত্রও তোমাকে দিব; আমি তাহাকে আশীর্ব্বাদ করিব, তাহাতে সে জাতিগণের [আদিমাতা] হইবে, তাহা হইতে লোকবৃন্দের রাজগণ উৎপন্ন হইবে।”—আদিপুস্তক ১৭:৫, ১৫, ১৬.

যিহোবা চুক্তি করেছিলেন, এক বংশের মাধ্যমে সমস্ত জাতি আশীর্বাদপ্রাপ্ত হবে আর এই বংশ সারার পুত্রের মাধ্যমে আসবে! ঈশ্বর এই পুত্রের জন্য যে-নাম বাছাই করেছিলেন, তা হল ইস্‌হাক আর এই নামের অর্থ হল “হাস্য।” অব্রাহাম যখন প্রথম জানতে পারেন, যিহোবা তাঁর উদ্দেশ্য অনুযায়ী সারাকে এক সন্তান দিয়ে আশীর্বাদ করতে চলেছেন, তখন অব্রাহাম “উবুড় হইয়া পড়িয়া হাসিলেন।” (আদিপুস্তক ১৭:১৭) তিনি আশ্চর্য হয়ে যান আর সেইসঙ্গে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন। (রোমীয় ৪:১৯, ২০) আর সারার বিষয়ে কী বলা যায়?

এর কিছু দিনের মধ্যেই তিন জন অপরিচিত ব্যক্তি অব্রাহামের তাঁবুতে আসেন। এটা ছিল দুপুর বেলা কিন্তু অতিথিদের দেখে এই বয়স্ক দম্পতি তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে অভ্যর্থনা জানান। অব্রাহাম সারাকে বলেন: “শীঘ্র তিন মাণ উত্তম ময়দা লইয়া ছানিয়া পিষ্টক প্রস্তুত কর।” তখনকার সময় আতিথেয়তা দেখানোর জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতে হতো। অব্রাহাম তার স্ত্রীর কাঁধে সমস্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দেননি; তিনি ছুটে গিয়ে একটা বাছুর মারেন এবং আরও কিছু খাদ্য ও পানীয় প্রস্তুত করেন। (আদিপুস্তক ১৮:১-৮) পরে দেখা যায়, এই ‘পুরুষেরা’ হলেন যিহোবার দূত! প্রেরিত পৌল সম্ভবত এই ঘটনার কথা মাথায় রেখে পরে লিখেছিলেন: “তোমরা অতিথিসেবা ভুলিয়া যাইও না; কেননা তদ্দ্বারা কেহ কেহ না জানিয়া দূতগণেরও আতিথ্য করিয়াছেন।” (ইব্রীয় ১৩:২) আপনি কি আতিথেয়তা দেখানোর বিষয়ে অব্রাহাম ও সারার এই অপূর্ব উদাহরণ অনুকরণ করতে পারেন?

সারা আতিথেয়তা দেখাতে ভালোবাসতেন

স্বর্গদূতদের মধ্যে এক জন অব্রাহামের কাছে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা পুনরাবৃত্তি করে বলেন, সারা এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেবে। সেইসময় সারা তার তাঁবুর ভিতর থেকে এই কথা শোনেন। এই বয়সে সন্তান জন্ম দেওয়ার কথা চিন্তা করা তার কাছে এতটাই অদ্ভুত লেগেছিল যে, তিনি হাসি চেপে রাখতে না পেরে বলে ওঠেন: “আমার এই শীর্ণ দশার পরে কি এমন আনন্দ হইবে? আমার প্রভুও ত বৃদ্ধ।” স্বর্গদূত সারাকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার মাধ্যমে সংশোধন করেন, “কোন কর্ম্ম কি সদাপ্রভুর অসাধ্য?” আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো সারাও ভয় পেয়ে যান ও আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেন। তিনি সঙ্গেসঙ্গে বলে ওঠেন: “আমি হাসি নাই।” কিন্তু স্বর্গদূত তাকে বলেন: “অবশ্য হাসিয়াছিলে।”—আদিপুস্তক ১৮:৯-১৫.

সারার হাসি কি প্রমাণ দেয়, তার বিশ্বাসের অভাব ছিল? একেবারেই না। বাইবেল জানায়: “বিশ্বাসে স্বয়ং সারাও বংশ উৎপাদনের শক্তি পাইলেন, যদিও তাঁহার অতিরিক্ত বয়স হইয়াছিল, কেননা তিনি প্রতিজ্ঞাকারীকে বিশ্বাস্য জ্ঞান করিয়াছিলেন।” (ইব্রীয় ১১:১১) সারা যিহোবাকে ভালোভাবে জানতেন; তিনি জানতেন যিহোবা তাঁর করা যেকোনো প্রতিজ্ঞা পরিপূর্ণ করতে পারেন। আমাদের মধ্যে সবারই এই ধরনের অধিক বিশ্বাসের প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের আরও ভালোভাবে বাইবেলে উল্লেখিত ঈশ্বর সম্বন্ধে জানতে হবে। আমরা যখন তা করি, তখন আমরা জানতে পারি, সারা উপযুক্ত কারণেই এই ধরনের বিশ্বাস বজায় রেখেছিলেন। যিহোবা সত্যিই বিশ্বস্ত এবং তিনি তাঁর সমস্ত প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করেন। একেক সময় তিনি এমন এক উপায় অবলম্বন করতে পারেন, যেটা আমাদের অবাক করে দেয় কিংবা আমরা হয়তো অবিশ্বাসের হাসি হাসতে পারি!

‘তাহার কথা শুন’

যিহোবা সারাকে তার চমৎকার বিশ্বাসের জন্য পুরস্কৃত করেছিলেন

অবশেষে ৯০ বছর বয়সে সারার জীবনে সেই আনন্দময় মুহূর্ত আসে, যেটার জন্য তিনি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ছিলেন। তিনি তার প্রিয় স্বামীর জন্য এক পুত্রসন্তান প্রসব করেন। সেইসময় অব্রাহামের বয়স ছিল ১০০ বছর! যিহোবার নির্দেশনা অনুযায়ী অব্রাহাম এই শিশুর নাম রাখেন ইস্‌হাক বা “হাস্য।” সারা বলেন: “ঈশ্বর আমাকে হাস্য করাইলেন; যে কেহ ইহা শুনিবে, সে আমার সহিত হাস্য করিবে।” (আদিপুস্তক ২১:৬) এই কথাগুলো বলার সময় আমরা হয়তো সারার ক্লান্ত কিন্তু হাসিভরা মুখ কল্পনা করতে পারি। যিহোবার কাছ থেকে পাওয়া এই আশ্চর্য উপহার তাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আনন্দিত রেখেছিল। কিন্তু, এটা তার জন্য এক গুরুদায়িত্বও ছিল।

ইস্‌হাকের যখন পাঁচ বছর পূর্ণ হয়, তখন সেই পরিবার তার স্তন্যপান ত্যাগ করার দিন উদ্‌যাপনের জন্য এক মহাভোজ প্রস্তুত করে। কিন্তু সবাই খুশি ছিল না। বিবরণে আমরা পড়ি, সারা কারো আচরণে এমন কিছু “দেখিলেন,” যেটা তার কাছে বিরক্তিকর বলে মনে হয়েছিল। সারা লক্ষ করেন, হাগারের ১৯ বছর বয়সি ছেলে ইশ্মায়েল ইস্‌হাককে অনবরত পরিহাস করছে। এটা খেলার ছলে ঠাট্টাতামাশা ছিল না। পরে প্রেরিত পৌল অনুপ্রাণিত হয়ে ইশ্মায়েলের এই আচরণকে তাড়না বলে উল্লেখ করেন। সারা বুঝতে পারেন, এই হয়রানি তার সন্তানের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উপর বিশাল ক্ষতি নিয়ে আসবে। সারা ভালোভাবেই জানতেন, ইস্‌হাক শুধু তার সন্তানই নয় কিন্তু যিহোবার উদ্দেশ্যের মধ্যে তার এক মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। তাই তিনি সাহস সঞ্চয় করে সরাসরি অব্রাহামের সঙ্গে কথা বলেন। সারা অব্রাহামকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন হাগার ও ইশ্মায়েলকে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেন।—আদিপুস্তক ২১:৮-১০; গালাতীয় ৪:২২, ২৩, ২৯.

অব্রাহাম কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখান? আমরা পড়ি: “এই কথায় অব্রাহাম আপন পুত্ত্রের বিষয়ে অতি অসন্তুষ্ট হইলেন।” তিনি ইশ্মায়েলকে ভালোবাসতেন এবং এই ব্যাপারে পিতৃস্নেহটাই তার কাছে বড়ো হয়ে ওঠে, এর বাইরে তিনি কোনো কিছুই দেখতে পাননি। কিন্তু, যিহোবা বিষয়টাকে স্পষ্টভাবে দেখেছিলেন আর তাই তিনি হস্তক্ষেপ করেন। বিবরণ জানায়: “আর ঈশ্বর অব্রাহামকে কহিলেন, ঐ বালকের বিষয়ে ও তোমার ঐ দাসীর বিষয়ে অসন্তুষ্ট হইও না; সারা তোমাকে যাহা বলিতেছে, তাহার সেই কথা শুন; কেননা ইস্‌হাকেই তোমার বংশ আখ্যাত হইবে।” যিহোবা অব্রাহামকে আশ্বাস দেন, হাগার ও তার ছেলের প্রয়োজনীয় বিষয়বস্তু জোগানো হবে। বিশ্বস্ত অব্রাহাম এই পরামর্শ মেনে নেন।—আদিপুস্তক ২১:১১-১৪.

সারাই ছিলেন অব্রাহামের প্রকৃত স্ত্রী অর্থাৎ একজন যোগ্য সাথি। তার স্বামী যে-কথাগুলো শুনতে ভালোবাসেন, তিনি শুধু সেগুলোই তাকে বলতেন না। যখন তার পরিবার ও তাদের ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িত কোনো সমস্যা তার চোখে পড়ত, তখন তিনি অকপটভাবে তার স্বামীকে তা জানাতেন। তার এই অকপট কথা বলার ধরনকে অসম্মান বলে ধরে নেওয়া উচিত নয়। আসলে, প্রেরিত পিতর যিনি নিজেও একজন বিবাহিত ব্যক্তি ছিলেন, পরবর্তী সময়ে সারাকে স্ত্রীদের জন্য এক চমৎকার উদাহরণ স্থাপনকারী হিসেবে উল্লেখ করেন, যিনি তার স্বামীর প্রতি গভীর সম্মান দেখাতেন। (১ করিন্থীয় ৯:৫; ১ পিতর ৩:৫, ৬) সত্য বিষয়টা হল, সারা যদি এই ব্যাপারে চুপ থাকতেন, তা হলে তিনি অব্রাহামকে সম্মান করতে ব্যর্থ হতেন আর এর জন্য অব্রাহাম ও তার পুরো পরিবারকে চরম মূল্য দিতে হতো। সারা কোমলভাবে উপযুক্ত কথাই বলেছিলেন।

অনেক স্ত্রীরাই সারার উদাহরণকে মূল্যবান বলে মনে করে। সারার কাছ থেকে তারা শেখে, কীভাবে স্বামীদের সঙ্গে খোলাখুলি ও সম্মানপূর্বক কথা বলা যায়। কোনো কোনো স্ত্রী একেক সময় আশা করেন, যিহোবা যেমন সারার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছিলেন, তাদের ব্যাপারেও যেন তিনি তা করেন। এমনটা না ঘটলেও, তারা সারার অসাধারণ বিশ্বাস, প্রেম ও ধৈর্য থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে।

যিহোবা সারাকে “রাণী” বলে সম্বোধন করেছিলেন কিন্তু সারা কখনো আশা করেননি, অন্যেরা তাকে রানির মতো দেখবে

যদিও যিহোবা নিজে এই প্রিয় নারীকে “রাণী” নাম দিয়েছিলেন কিন্তু সারা কখনো আশা করেননি, অন্যেরা তাকে রানির মতো দেখবে। তাই এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, সারা যখন ১২৭ বছর বয়সে মারা যান, তখন অব্রাহাম “সারার নিমিত্তে শোক ও রোদন করিতে আসিলেন।” * (আদিপুস্তক ২৩:১, ২) তিনি কখনো তার প্রিয়তমা ‘রাণীকে’ ভুলতে পারেননি। কোনো সন্দেহ নেই, যিহোবাও এই বিশ্বস্ত নারীকে মনে রেখেছেন আর পরমদেশ পৃথিবীতে তাকে পুনরায় জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য উৎসুক হয়ে আছেন। সারার জন্য অনন্তকালীন সুখের এক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে রয়েছে। আর যারা তার বিশ্বাস অনুকরণ করে, তারাও একই আশীর্বাদ লাভ করবে।—যোহন ৫:২৮, ২৯.

^ অনু. 3 আসলে, যতদিন না যিহোবা তাদের নতুন নামকরণ করেছিলেন, ততদিন তারা অব্রাম ও সারী নামে পরিচিত ছিলেন কিন্তু সহজভাবে বোঝার জন্য আমরা তাদের সেই নাম ব্যবহার করব, যে-নামে তারা সাধারণভাবে পরিচিত।

^ অনু. 10 যিহোবা কিছু সময়ের জন্য বহুবিবাহ ও উপপত্নী রাখার বিষয়টা অনুমোদন করেছিলেন কিন্তু পরবর্তী সময় তিনি যিশুকে অধিকার দিয়েছিলেন, যাতে তিনি বিবাহের ক্ষেত্রে এদনে স্থির করা এক জন বিবাহসাথি রাখার বিষয়ে আদি মানদণ্ড পুনর্স্থাপিত করেন।—আদিপুস্তক ২:২৪; মথি ১৯:৩-৯.

^ অনু. 25 বাইবেলে সারাই হলেন একমাত্র নারী, যার মৃত্যুকালের বয়স অনুপ্রাণিত নথিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।